সোমবার, 23 ডিসেম্বর , 2024 برابر با Sunday, 22 December , 2024
কর্ণাটকের সরকারি স্কুলে মেয়েদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।

মজিদুল ইসলাম শাহ

কর্ণাটকের সরকারি স্কুলে মেয়েদের হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।

ভারতে, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য তাদের আওয়াজ তুলে চলেছে, কারণ ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে।

কর্ণাটকে হিজাব নিষিদ্ধের বিষয়টি ইউনিফর্ম লঙ্ঘনের সাথে জড়িত নয় বরং এর পিছনে ফ্যাসিবাদী শক্তির ইসলামবিরোধী মানসিকতার সাথে জড়িত ৷ অন্যথায় মুসলিম ছাড়াও ভারতে অন্য শ্রেণীদের মধ্যে পর্দার প্রচলন রয়েছে।

কিছু কিছু এলাকায় ‘ঘোমটা’র সংস্কৃতি এখনও টিকে আছে, বিশেষ করে দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণীর মধ্যে ‘ঘোমটা’ হল পর্দার আর এক রূপ।

কিন্তু আধুনিক বিশ্ব ‘বোরখা’কে নারীর উন্নতির অন্তরায় পরিণত করে তাকে নগ্নতার দিকে ঝুঁকিয়েছে, যার ভিত্তিতে ‘ঘোমটা’কে স্টেরিওটাইপের আয়না আখ্যা দিয়ে নারীকে নগ্নতার কাদায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

তা না হলে অনেক নারীই ‘পর্দা’র মধ্যে জীবনযাপন করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করছেন, কিন্তু আমাদের দেশে আধুনিকতা ও নারী উন্নয়নের মাপকাঠি পশ্চিমাকৃত, তাই পর্দানশীন নারীদের অগ্রগতি কেউ দেখে না।

কর্ণাটকে মুসলিম মেয়েদের যেভাবে হয়রানি করা হয়েছে তা ফ্যাসিবাদী শক্তির মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে। একটি একাকী মেয়েকে ক্যাম্পাসে কয়েক ডজন ছেলে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে ঘিরে ফেলে তাকে হয়রানির চেষ্টা করা হয়।

মেয়েটি ভয় না করে জবাবে ‘আল্লাহ আকবর’ স্লোগান দেয়। এই স্লোগানটিও ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছিল ৷ তবে স্লোগানটি ধর্মীয় গোঁড়ামির উপর ভিত্তি করে নয় বরং নিজের পরিচয় প্রকাশ এবং ভয়ের জগতে আত্মবিশ্বাস, বিশ্বাস এবং সাহসের সন্ধানের উপর ভিত্তি করেছিল।

‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানের প্রতিক্রিয়া ছিল না কারণ তারা গুন্ডামি, হয়রানি এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ‘রাম’ নামে চিৎকার করছিল, যদিও আল্লাহু আকবরের স্লোগান কাউকে হয়রানি বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়নি।

প্রশ্ন হল যদি স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে কেন কলেজ ক্যাম্পাসে জাফরান শাল এবং গামছা দৃশ্যমান ছিল?

কলেজে তে-রঙার জায়গায় জাফরান পতাকা উত্তোলন করা হয়, যে ছেলেরা এই কাজ করেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ও প্রশাসন কি যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে?

একজন মুসলিম ছেলে যদি এমন কাজ করত তাহলে কি সরকার ও প্রশাসনের এমন ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া হতো?

বাস্তবতা হলো, ‘দেশ ভক্তি’ ও ‘হিন্দুত্ব’-এর নামে যা কিছু ঘটছে, তাতে সরকার ও প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।

নইলে শারজিল ইমামকে দোষী সাব্যস্ত করতে সরকার ও প্রশাসন যেভাবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল, তেরঙার বদলে যারা জাফরান পতাকা উড়িয়েছিল, তাদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে জেলে দিতে পারত। কিন্তু আমরা জানি এটা হবে না। কারণ সরকার জাফরান সংগঠনের হাতিয়ার আর প্রশাসন তাদের হাতের খেলনা।

নইলে যে দেশে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তিকে গুলি করে প্রতীকী রক্ত রঞ্জিত হচ্ছে এবং অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে সরকার ও প্রশাসনের কাছে বিচারের আশা করা বড় অন্যায় হবে।

পর্দা একটি ইসলামী পরিচয়। এই পরিচয় মুছে ফেলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কারণ ফ্যাসিবাদী শক্তি মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি দিয়ে মেনে নিতে চায় না। কারণ একটি জাতির পরিচয় যখন হারিয়ে যায় তখন তার মর্যাদাও সন্দেহজনক হয়ে ওঠে।

ভারতের মুসলমানদের নিজস্ব পরিচয় আছে যা জাফরান সংগঠনের জন্য অসহনীয়। তারা এই পরিচয় মুছে দিতে চায় এবং ভারতের মুসলমানরা ঠিক ওই ভাবে হয়ে উঠুক যেমন তারা দেখতে চায়।

তাই আজ স্কুলে হিজাব পরা নিষিধের দাবি উঠেছে ৷ আগামীতে হইতো বলা হতে পারে স্কুল-কলেজে দাড়িওয়ালা ছাত্রদের ভর্তি করা হবে না। এভাবে তাদের অন্যায় দাবীর কোনো সীমা নেই। আজ একজন মুসলমান একটি দাবি মেনে নেবে, কাল তার সামনে আরেকটি দাবী থাকবে। কিন্তু সমস্যা হল স্কুলগুলো হয় সরকারি বা বেসরকারিভাবে পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন। অবশ্যই তারা তাদের নীতি ও কৌশল অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করবে।

কেউ সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে পড়তে চাইলে তাদের তৈরি করা নিয়ম মানতে হবে। কারণ মুসলমানরা এসব স্কুল-কলেজের কমিটির সামনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের দাবি পেশ করে না।

উর্দু ভাষার পতনের অন্যতম কারণ হল মুসলিমরা স্কুলে উর্দুকে একটি বিষয় হিসেবে চালু করতে বলেনি। তারা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চায় কিন্তু তাদের পরিচয় দাবি না করে, অন্যথায় স্কুল থেকে দাবি করা যেতে পারে এবং তাদের রাজিও করানো যেতে পারে। কারণ স্কুল সমাজের প্রয়োজন এবং সেগুলি সমাজের মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়।

মুসলমানদের জন্য বড় অসুবিধা হল তারা অসংখ্য মাদ্রাসা, মহিমান্বিত মসজিদ, আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ করেছে কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেয়নি যেখানে আধুনিক শিক্ষা দেওয়া যায়।

কিছু লোক এতে আকৃষ্ট হয়েছিল কিন্তু তাদের অর্থের অভাব ছিল। কারণ আমাদের দেশের অধিকাংশ তহবিল ধর্মীয় শ্রেণীর হাতে রয়েছে যাদের হিসাব নেই এবং কাজে স্বচ্ছতা নেই।

ধার্মিক শ্রেণীর কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা, কল্যাণকর বিষয়ে অমনোযোগীতা এবং কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতার অভাবে জনগণ তাদের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। সেজন্য মৌলভীদের এ দিকে নজর দেওয়া দরকার।

যাই হোক, মুসলমানদের এ ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সাহায্য না চেয়ে স্বাবলম্বী হতে হবে। স্বাবলম্বী হতে, আপনাকে আলাদাভাবে কিছু করতে হবে না, তবে আপনাকে আপনার ‘আর্থিক বিষয়ে’ শৃঙ্খলা তৈরি করতে হবে। মাদ্রাসা, মসজিদ ও অন্যান্য জাঁকজমকপূর্ণ ধর্মীয় ভবনে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা স্বচ্ছ করতে হবে যাতে সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়।

যেখানে ধর্মীয় শ্রেণির প্রয়োজন নেই, সেখানে ওই শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত না করাই ভালো হবে। কেননা জাতির বর্তমান পরিস্থিতির সম্পূর্ণ দায় ধর্মীয় শ্রেণীর উপর বর্তায় যা জাতিকে ধর্মীয় বিষয়ে এতটাই জর্জরিত করে ফেলেছে যে, তারা আযাব থেকে মুক্তির কোনো পথ দেখছে না।

যখন জাতি এই সমস্যার সমাধান চায়, তখন তাদের আরও বৃত্তি এবং ধর্মীয় সমাবেশের প্রস্তাব দেওয়া হয়। জাতির সহানুভূতিশীল, আন্তরিক এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একত্রিত হয়ে নিজেদের সমাধানের জন্য সংগ্রাম করাই ভালো হবে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কিছু আশা করা অন্যায় হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।