সোমবার, 23 ডিসেম্বর , 2024 برابر با Sunday, 22 December , 2024

বি ইসমেহি তায়ালা

 

(১) মানত (نذر)

(২) আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা (سوگند به غیر خدا)

 

تالیف وترجمه: مجیدالاسلام شاه

সংকলন ও অনুবাদ:

 

মজিদুল ইসলাম শাহ

 

 

 

সূচিপত্র

মানত. 1

আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য মানত করা: 1

উক্ত মতামতের প্রত্যাখ্যান: 2

মানত সম্পর্কে মুসলমানদের নীতি: 5

নেক ব্যক্তিগণের ফতোয়া: 6

আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা.. 9

আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা: 9

আমরা উক্ত মতামতের কয়েক ভাবে উত্তর দিতে পারি: 10

)- পবিত্র কোরআনের আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ নেওয়া : 10

)- রেওয়ায়েতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ নেওয়া : 11

একটি আপত্তি বা প্রতিবাদ: 12

আপত্তি বা প্রতিবাদের উত্তর: 12

আবুতালিবের শপথ আর হযরত মুহম্মাদ (স:)এর সহায়তা: 13

সাহাবীগণের আমল: 13

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের হাদীসের উপর আপত্তি: 14

 

 

মানত

আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য মানত করা:

ইসলামের শাখা-প্রশাখা ‘আহকামের’ একটি অন্যতম আহকাম হল ‘মানত’। মানুষ মানত করার সময় এই ইচ্ছা পোষণ করে, যে যদি আমার ওই প্রয়োজনীয় কাজটা সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে আমি আল্লাহর জন্য এই কাজটি করবো। এই আদেশ মুসলমানদের মধ্যে পূর্বেও ছিল এবং পরবর্তীতেও আছে।

তবে ওহাবীগণের বিশ্বাস যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে মানত করা হারাম, তার কারণ এই ধরনের মানত করা মুশরিকগণের মূর্তির জন্য মানত করার সমতুল্য। সাধারণতঃ এই সব কারণেই আল্লাহর সম্পর্কে (غلو)   গুলু বা এক ধরনের আলাদা বিশ্বাস সামনে আসে।

কাসিমী বলেন: শিয়া সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে থেকে একটি হল আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য মানত করা, কারণ তারা হযরত ‘আলী’ এবং তার সন্তানগণের সম্পর্কে ‘আল্লাহর’ বিশ্বাস রাখেন। [1]

ইবনে তাইমিয়া এ সম্পর্কে এই ভাবে নিজের মত প্রকাশ করেছেন: আমাদের আলেমগণের মতামত এই হল যে, কবর এবং কবরের খাদেমের জন্য দিরহাম, তেল, প্রদীপ, বা পশুদের মানত করা জায়েয নয়, কারণ এই ধরনের মানত করা গুনাহ। সহীহ রেওয়ায়েতে বর্ণনা হয়েছে যে, কেউ যদি আল্লাহর ইবাদতের মানত করে তাহলে তাকে আল্লাহর ইবাদত করা দরকার আর যদি কেউ গুনাহ করার জন্য মানত করে তাহলে সেটার উপর আমল না করা দরকার। [2]

ইবনে তাইমিয়া আরও বলেন: শিরকে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে মৃত ব্যক্তির কাছে অভিযোগ জানাতে বারন করেছেন যদি সে নবীও হয় সুতরাং কবর বা তার ইমারতের জন্য মানত করা হারাম এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধরনের মানত মুশরিকদের মানতের সমতুল্য, যা তারা তাদের মূর্তির জন্য করে থাকে আর যে ব্যক্তি এই ধরনের বিশ্বাস রাখে যে, কবরের জন্য মানত করলে উপকার বা সওয়াব আছে তাহলে মনে কর সে পথভ্রষ্ট। [3]

উক্ত মতামতের প্রত্যাখ্যান:      

আমরা ইবনে তাইমিয়ার উক্ত বিশ্বাসের কয়েক ভাবে উত্তর দিতে পারি:

১- প্রথমতঃ এই যে মানতকারীর উদ্দেশ্য এটা হয় যে, এই সাদকা বা হাদিয়ার সওয়াব আল্লাহর নবী বা ওলীগণকে হাদিয়া করা, আর এই ভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। অতএব কি করে হতে পারে যে, তাদের উদ্দেশ্য নবী বা ওলী আবার অন্য দিকে তারা মৃত না খেতে পারে আর না পরিধাণ করতে পারে?

২- এই মানত সম্পূর্ণ ওই মানুষের আমলের মতো যে নিজের পিতার জন্য মানত করে বা শপথ করে বা সে নিজেই নিজের অম্তরে নিয়ত করে যে, সে তার পিতার জন্য সাদকা দেবে।

রেওয়ায়েতে বর্ণনা হয়েছে যে, মাইমুনা বলেন: হযরত মুহম্মাদ (স:)এর যুগে আমার পিতা মানত করেছিলেন যে, একটি বিশেষ স্থানে ৫০ টি ছাগল কুরবানী করবে।

হযরত মুহম্মাদ (স:) বললেন: ওখানে কি মূর্তির জন্য কুরবানী করা হয়?

মাইমুনা বললেন: না, হযরত মুহম্মাদ (স:) বললেন: (اوف بنذرك) নিজের মানতের উপর আমল কর। [4]

আমার মনে হয় হযরত মুহম্মাদ (স:) এই কারণে প্রশ্ন করলেন যে, ওখানে মূর্তিপূজা করা হয় বা মুশরিকগণ ওখানে নিজেদের প্রথা বা নিয়মের উপর আমল করতো কারণ মুসলমান ইসলামের পূর্বের যুগে জীবন যাপন করছিল তাই এই জিনিসের সম্ভাবনা থাকতে পারে।

আমরা এর সহায়তায় একটি রেওয়ায়েতে বর্ণনা করি যেটা সাবিত ইবনে যাহাক হতে বর্ণিত হয়েছে: এক ব্যক্তি মানত করল যে, (বাওনা) নামক স্থানে একটি উট কুরবানী করবে, হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে এসে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন: হযরত মুহম্মাদ (স:) বললেন: ওখানে ইসলামের পূর্বের যুগে কি কোনো মূর্তি ছিল যার পূজা করতো? সাবিত ইবনে যাহাক বলেন: না, হযরত মুহম্মাদ (স:) বললেন:

(اوف بنذرك, فانه لا وفاء لنذر في معصيه الله ولا فيما لا يملك ابن أدم)

অর্থ: তোমরা নিজের মানতের প্রতি আমল কর কারণ শুধুমাত্র দুটি স্থানে মানত করা ঠিক নয়। ১- আল্লাহর আদেশ অমান্য করাতে ২- সেই জিনিসের জন্য মানুষ যার মালিক হতে পারে না।[5]

পূর্বে আমরা বলেছি যে, কোন মুসলমান ব্যক্তি মানত করার সময় এইকথা বলে থাকে: যদি আমার ওই ইচ্ছাটা পূরণ হয়ে যায় তাহলে আমি আল্লাহর জন্য এই কাজটা করবো। সুতরাং যখন সে এই কথা বলবে: আমি উমুকের জন্য মানত করছি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এটা হল একটি কৃত্রিম ব্যাখ্যা আর সংক্ষিপ্তের কারণে এই ভাবে বলা হয়। তাছাড়া সত্যিকারে তার উদ্দেশ্য এটাই হয় যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবো যাতে তার সওয়াব সেই ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যায়।

৩- যদি কোনো মুসলমানের আমল কোনো কাফিরের আমলের সাদৃশ্য হয় তাহলে কী সেই মুসলমানকে কাফির বলা যেতে পারে? ইবনে তাইমিয়া এই প্রমাণের ভিত্তিতে মুসলমানদের প্রতি কাফির হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন, তবে আমরা এখানে বলবো যে, যদি শুধুমাত্র সাদৃশ্যতার কারণে কাউকে কাফির বলা যেতে পারে, তাহলে হজ্বের আহকামও তো ঠিক এমনই, কারণ মুশরিকরা নিজেদের মূর্তির আশে পাশে তাওয়াফ করতো আর তার পূজো করতো। এছাড়া কুরবানীর দিন কুরবানীও করতো আর আমরাও কুরবানী করি তাহলে কি এই দুটো আমলকে একইরকম ভাবা ঠিক হবে?

এছাড়া হযরত মুহম্মাদ (স:) বলেন: (انما الاعمال بالنيات)   অর্থ: নিশ্চই আমল নিয়তের উপর নির্ভর করে। [6]

আযামী শাফেয়ী এ সম্পর্কে বলেছেন: যদি কোনো ব্যাক্তি মুসলমানদের ভাল চরিত্রের মানুষের জন্য মানত বা কুরবানীর উদ্দেশ্যে গবেষণা করে তাহলে সে এই ফলাফলে পৌঁছাবে যে, তাদের উদ্দেশ্য এছাড়া অন্য কিছু নয় যে, এই সাদকা বা হাদিয়ার সাওয়াব মৃত ব্যক্তির পর্যন্ত পৌঁছে যায় আর তার উপকারে যেন আসে। [7]

আর আযামী এ কথাও সংযোজন করে বলেছেন: মানত করা শারয়ী আমল হওয়ার দিক থেকে সহীহ এবং গ্রহণযোগ্য রেওয়ায়েত আমাদের কাছে আছে। তারই একটি রেওয়ায়েতে সাআদ থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন: আমি হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম: আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন এবং আমি জানি যদি আমার বেঁচে থাকতেন তাহলে সাদকা দিতেন কিন্তু এখন যদি আমি সাদকা দেই তাহলে তার কোনো উপকার হবে? হযরত মুহম্মাদ (স:) বললেন: হ্যাঁ-হবে আবার জিজ্ঞাসা করলো: কোন জিনিসের সাদকা দেওয়া উত্তম? হযরত মুহম্মাদ (স:) বললেন: পানি।

সাআদ একটি কুঁয়ো তৈরি করে বললো: هذا لام سعد  এটি সাআদ’র মায়ের জন্যে। [8]

তবে এসম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া এবং তার অনুসারীগণ ভুল করেছে কারণ যখনি কোনো মুসলমান এই দাবী করবে যে (هذه الصدقه للنبي او للولي) অর্থ: এই সাদকা নবী বা ওলীর জন্য।

এটি স্পষ্ট যে, ইবনে তাইমিয়া ভুল পথ গ্রহণ করেছেন কারণ  (لله) তে যে (ل)  এর কথা বলা হয়েছে সেটি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের অর্থকে বোঝায় আর  (للنبي او للولي) এটিতে সাদকা দেওয়ার কথাকে বর্ণনা করে।

মানত সম্পর্কে মুসলমানদের নীতি: 

পূর্বে ইশারা করেছি যে, মুসলমানদের নীতি এটাই ছিল যে, তারা মানত করতো এবং সেটি কবুলও হত।

আহলে সুন্নতের আলেমগণের মধ্যে খালেদি বলেন: আল্লাহর নবী বা আল্লাহর ওলীগণের জন্যে মানত করার মানে হল: আল্লাহর তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং তার নেকি হাদিয়া করা। আর অনুরূপ যদি কেউ বলে যে, আমি আমার পিতামাতার জন্যে কুরবানী করেছি, মানে তাদের হয়ে সাদকা দিলাম। [9] উদাহরণ স্বরূপ ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে, শেখ আহমাদ ইবনে আলী বাদভীর মৃত্যু ৬৫ হিজরী সনে হয় এবং তাকে ‘তানাদতা’ শহরে দাফন করা হয় এবং তার কবরের উপর ইমারত তৈরি করা হয়, তার কেরামত খুবই বিখ্যাত আর মানুষজন তার জন্যে খুব বেশি কুরবানী করেন। [10]

এর আরও নমুনা আছে যেমন: আহমাদ ইবনে জাফার খাযরায়ীর কবর, যে আবুল আব্বাস নামে বিখ্যাত। তিনি মারাকিশ শহরের অধিবাসী ছিলেন, ৬০১ হিজরী সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখনো তার কবর যিয়ারতের একটি স্থান এবং বহু মানুষ তার যিয়ারত করতে যায় এবং সেখানে দোয়া কবুল হয়। আমি কয়েক বার সেই কবরের যিয়ারত করেছি এবং সেই কবরের বরকত সম্পর্কে পরীক্ষাও করেছি।

ইবনে খাতিব সালমানী বলেন: আহমাদ বুসতীর কবরে প্রতিদিন মানত করা ৮০০ মিসকাল খাটি সোনা জমা হত এবং কখনো কখনো এক হাজার দিনার পর্যন্তও পৌছে যেতো। [11]

তিনি এসম্পর্কে আরও বলেন: এই ধরনের আমল বর্তমানেও জারী আছে এবং পাঁচশতরও অধিক সেই কবরের যিয়ারত করেছি। ত্রিশটি রাত্রি সেখানে অতিবাহিত করেছি এবং সেই কবরের বরকত দেখেছি। [12]

নেক ব্যক্তিগণের ফতোয়া: 

মানত সম্পর্কে বর্ণনা করা রেওয়ায়েতের কারণে আহলে সুন্নত আলেমগণ তার শরিয়তী দিক থেকে জায়েয হওয়ার ফতোয়া দিয়েছেন।

আবু দাউদের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করার পর খালেদি বলেন: খাওয়ারীজ এই হাদীসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে নবীগণ বা নেক ব্যক্তিগণের কবরের জন্য মানত করাকে অবৈধ মনে করেন। তার কারণ হল তারা নবীগণ বা নেক ব্যক্তিগণকে মূর্তির সমতুল্য আর তার সম্মান করাকে ইসলামের পূর্ব যুগের ঈদের মতো মনে করে।

আমরা তাদের এই জঘন্যতম বিশ্বাস থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই! এই ধরনের চিন্তা হল খাওয়ারিজদের পথভ্রষ্ট ও তাদের কুসংস্কারের ফল যা তারা দ্বীন ইসলামের নামে শরীয়তে প্রবেশ করিয়েছে এবং আল্লাহর নবীগণ ও নেক ব্যক্তিগণকে মূর্তি বলে তাদের অসম্মান ও অপমান করেছে। তারা নবীগণের সাথে বেআদবী ও অসম্মান করেছে, কিন্তু যদি কেউ খাওয়ারিজদের উপর অভিযোগ করে আর যদিও এই অভিযোগ ইশারার মাধ্যমে করে থাকে তাদেরকে কাফির বলে গণ্য করে, এমনকি তারা কিছু স্থানে তাদের সম্পদ, আত্মা, ও তাদের নারীদেরকেও ব্যবহার করাকে বৈধ মনে করে। খাওয়ারিজ নবীগণ ও অলিগণের কাছে তাওস্সুল করাকে ইবাদত মনে করে। এই কারণে খাওয়ারিজরা অপদস্থ হয়েছে। খাওয়ারিজদের অজ্ঞ মতামতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়, কারণ তাদের চিন্তাধারা পথভ্রষ্ট ছিল এবং আল্লাহ তাআলা হলেন সব থেকে জ্ঞ্যানী। [13]

আযামী শাফেয়ী এসম্পর্কে লিখেন: পূর্বের কিছু আলেমগণ ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্যদের উপর বিশ্বাস করে ও ত্রুটি করে ফেলে ছিল আসলে ইবনে তাইমিয়া ও তার শিষ্যদের কথা হল দ্বীন ইসলামে প্রতারণা করা আর মানুষকে ধোকা দেওয়া। তারা দ্বীনি আহকামের এমন ভাবে অর্থ করে যা একজন মুসলমানের দ্বারায় এই ধরনের কথা মুখে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

যদি কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের নবীগণ বা অলিগণের জন্য কুরবানী দেওয়া বা মানত করা সম্পর্কে গবেষণা করে, তাহলে সে এই ফলাফলে পৌঁছাবে যে, তাদের ইচ্ছা হল তাদের পক্ষ্য থেকে সাদকা দেওয়া আর এর পূণ্য তাদের আত্মা পর্যন্ত পৌঁছানো।

আহলে সুন্নত আলেগণের ইজমা এটাই যে, জীবিত মানুষ মৃত মানুষের জন্যে সাদকা দিতে পারে এতে মৃত মানুষেরই উপকার হবে। এসম্পর্কে যে রেওয়ায়েতগুলো বর্ণনা হয়েছে সেগুলো সহীহ এবং বিখ্যাত। এই কারণে নবীগণ বা অলিগণের জন্য কুরবানী বা মানত করা ছাড়াও অনান্য কাজ করা যা প্রথম থেকেই মুসলমানদের মধ্যে প্রচলন ছিল এগুলো বিশেষ কোনো দল থেকে নির্দিষ্ট নয়।

 

 

 

 

 

 

 

আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা

 

 

 

 

 

 

 

আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা:   

আপনারা ‘শপথ’ সম্পর্কে অবগত আছেন যে, এটি একটি যুক্তিসঙ্গত কাজ যা পবিত্র কুরআন ও নবী (সঃ)-এর সুন্নতে বর্ণিত হয়েছে। তবে ওহাবীরা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে শপথ করাকে নিষেধ করে থাকে আর এটাকে কিছু আলেমগণ সম্পূর্ণ শির্ক মনে করে আর কিছু মানুষ শির্ক এ আসগার (ক্ষুদ্র শির্ক) মনে করে।

ইবনে তাইমিয়া বলেন শির্ক দুই প্রকার:

১- শির্ক এ আকবার (বৃহত শির্ক): বিভিন্ন প্রকারের আছে… তার মধ্যে থেকে একটি হল আল্লাহর সৃষ্টির নিকটে তাওয়াসসুল করা এবং তার মাধ্যমে শাফাআত প্রার্থনা করা।

২- শির্ক এ আসগার (ক্ষুদ্র শির্ক): শির্ক এ আসগারের উদাহরণ হল: লোক দেখানো কাজ করা, এর আর একটি অংশ হল আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা।

রেওয়ায়াতে আছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন: হযরত মুহম্মাদ (স:) বলেছেন:

(و من حلف بغير الله فقد اشرك و….)  অর্থ: যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করে সে শিরক করেছে…। শির্ক এ আসগার মুসলমানকে দ্বীন ইসলামের গন্ডি থেকে বার করে না তবে তা থেকে তওবা করা দরকার। [14]

সুনআনী নিজের ‘তাতহিরুল এতেকাদ’ নামক পুস্তকে কবরে যাওয়া মানুষের দিকে শিরক সম্পৃক্ত করে বলেন : যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামের দ্বারা শপথ করে থাকে যদিও তারা তাদের অধিকারকে প্রমাণ করার জন্য করে থাকে তার পরও তাদের এই ধরনের শপথ গ্রহণযোগ্য নয়, তবে যদি ওলিদের মধ্যে কারোর নামে শপথ করে, তাহলে সেটি গ্রহণীয় হবে,  তবে এটি হল মূর্তি পূজার সমতুল্য হবে। [15]

আমরা উক্ত মতামতের কয়েক ভাবে উত্তর দিতে পারি:

১- আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে, হযরত মুহম্মাদ (স:), সাহাবীগণ, তাবেয়ীন এবং সমস্ত মুসলমান থেকে অতিত থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে।

)- পবিত্র কোরআনের আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ নেওয়া :

পবিত্র কোরআনে শপথ সম্পর্কে বহু আয়াত বর্ণনা হয়েছে।

যেমন সুরা ‘আসর’   (وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ)

কালের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে (নিমজ্জিত) আছে,।

)وَالنَّازِعَاتِ غَرْقاً (1) وَالنَّاشِطَاتِ نَشْطاً সুরা ‘নাযেয়াত’ (

শপথ তাদের যারা (অবিশ্বাসীদের) প্রাণ নির্মমভাবে টেনে বের করে, শপথ তাদের যারা (বিশ্বাসীদের) প্রাণ মৃদুভাবে বের করে নেয়,।

)وَالضُّحَى (1) وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَى সুরা ‘যোহা’ (

শপথ পূর্বাহেুর, শপথ রজনীর যখন তা নিঝুম হয়,।

)وَالْعَادِيَاتِ ضَبْحاًসুরা ‘আদেয়াত’ (

শপথ ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান অশ্বরাজির,।

এছাড়া আরও অনেক আয়াত কোরআনে বর্ণনা আছে যাতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করার কথা বর্ণনা হয়েছে। যদি এটা বলা হয় যে এই ধরনের শপথ আল্লাহর জন্য জায়েয (বৈধ) হবে আর বান্দাদের জন্য জায়েয হবে না। তাহলে এর উত্তরে আমরা এই ভাবে বলবো : আল্লাহ তায়ালা কী সৃষ্টি শপথ করে কোন ব্যক্তিকে নিজের শরিক করেছেন? আর যদি আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা শিরক হয় আর সেই অন্যকে আল্লাহর সাথে তুলনা করা হয় তাহলে আল্লাহ থেকে এই ধরনের কাজ সম্পাদন হওয়াও অপছন্দনীয় কাজ।

)- রেওয়ায়েতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ নেওয়া :

রেওয়ায়েতে বর্ণনা হয়েছে যে, একদিন এক ব্যক্তি হযরত মুহম্মাদ (স:)এর নিকটে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করলেন যে, কোন সাদকার নেকি বেশি ?

হযরত মুহম্মাদ (স:) বললেন :

(اما و ابيك لتنبانه ان تصدق و انت صحيح شحيح تخشي الفقر و تامل البقاء)

অর্থ : তোমাকে তোমার বাবার কসম (শপথ) করে বলছি : তুমি তা থেকে জানতে পারবে, তাই তুমি যতদিন সুস্থ আছ সাদকা দিতে থাক, দরিদ্রতার শঙ্কা রাখ আর জীবিত থাকার আশা রাখ।[16]

আর একটি রেওয়ায়েতে বর্ণনা হয়েছে: একদিন একজন ‘নাজদী’ ব্যক্তি হযরত মুহম্মাদ (স:)এর নিকট ইসলাম সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করলো হযরত মুহম্মাদ (স:) পরিশেষে বললেন:

(افلح و ابيه ان صدق) অর্থ: তার পিতার কসম! যদি সত্যি বল সফল হয়ে যাবে। [17]

একটি আপত্তি বা প্রতিবাদ:

কাসতালানী লেখেন : ইবনে আব্দুল বর বলেন: (افلح و ابيه) তার পিতার কসম, একথাটি একটি দুর্বল হাদীসে বর্ণনা হয়েছে যেটি বিখ্যাত নয়। কারণ ‘সিহাহে সিত্তা’তে এই হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। [18]

আপত্তি বা প্রতিবাদের উত্তর:

(اما و ابيك) এই হাদীস ওই হাদীসকে নিশ্চিত করছে। একারণে এই হাদীস নিষিদ্ধ নয়। ইবনে আব্দুল বর বলেন: আসলে হাদীস (افلح و الله و ابيك) এই ভাবে ছিল পরে (و ابيه) তে পরিবর্তন হয়ে যায়।

কাসতানী এই উত্তরকে গ্রহণ করেনি আর আবু বকরের কথা বর্ণনা করে বলেন : বায়হাকীর উত্তর : এর উপযুক্ত কারণ হল যে, এই ধরনের শব্দ (و ابيك) আরববাসীরা নিজের কথাপোকথনে বিনা কোনো অর্থে ও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকে অথবা বাক্যটি এই ভাবে (افلح و رب ابيه) ছিল কিন্তু খুব বেশি ব্যবহারের ফলে (رب) শব্দ ম্লান  হয়ে গেছে। [19]

সৈয়দ আমীন এর উত্তরে বলেন : আরববাসী কোনো শব্দের অর্থ বিনা উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেনা এটি অসম্ভব, তাই যখনি এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন তা থেকে শপথ করাকে উদ্দেশ্য করা হয় আর (رب ابيك) এই শব্দটি বাক্যের মধ্যে লুকাইত আছে বলে তার কোনো প্রমাণ নেই। [20]

আবুতালিবের শপথ আর হযরত মুহম্মাদ (স:)এর সহায়তা:

হাদীসে বর্ণনা হয়েছে যে, একদিন হযরত আবুতালিব (আ:) হযরত মুহম্মাদ (স:)এর সম্পর্কে কবিতা বর্ণনা করলেন: كذبتم و بيت الله يبزي محمد      ولما نطاعن دونه و نناضل

অর্থ: হযরত আবুতালিব (আ:) এই কবিতায় আল্লাহর ঘরের শপথ করেছেন, হযরত মুহম্মাদ (স:) সেটি শুনলেন এবং কিছু বললেন না। [21]

সাহাবীগণের আমল:

এটা স্পষ্ট যে, সাহাবাগও আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করতেন, আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর বলেন: যখনি নিজের চাচা হযরত আলী (আ:)এর কাছে কোনো জিনিসের দরখাস্ত করতাম তিনি গ্রহণ করতেন না কিন্তু যখন জাফরের কসম দিতাম তখন গ্রহণ করতেন। [22]

নাহজুল বালাগায় বর্ণনা হয়েছে যে, ইমাম আলী (আ:) মোয়াবিয়ার নাম একটি চিঠিতে লেখেন:

(و لعمري يا معاويه! لئن نطرت بعقلك دون هواك لتجدني ابرء الناس من دم عثمان)

হে মোয়াবিয়া! আমার জীবনের কসম! যদি তুমি নিজের প্রত্যাশা থেকে দূরে সরে এসে নিজের বিবেকের দৃষ্টিতে দেখ তাহলে আমাকে উসমানের হত্যা হতে সব থেকে বেশি নির্দোষ পাবে।[23]

রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, মাসরুক হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কবরের দিকে ইশারা করে হযরত আয়েশার কাছে খাওয়ারিজদের সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন: তোমাকে এই কবরের ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তির কসম! তুমি খাওয়ারিজদের সম্পর্কে কি শুনেছো ?!

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের হাদীসের উপর আপত্তি:

এখন আমরা এই হাদীস সম্পর্কে গবেষণা করব, যেটা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ না করাকে বর্ণনা করেছে।

তিরমিযী বর্ননা করেন : একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর একজনকে কাবার শপথ করতে শুনলেন! আব্দুল্লাহ তাকে বললেন : আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ কর না, আমি হযরত মুহম্মাদ (স:) থেকে শুনেছি তিনি বলেছেন: ( من حلف بغير الله فقد کفر) অর্থ: যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করবে সে কাফির হয়ে যাবে। [24]

এই হাদীসে দুই ধরনের সমস্যা আছে।

১- সনদ বা বর্ণনাকারীদের ধারা ২- বিষয়বস্তু বা অর্থগত দিক

প্রথমত সনদ সম্পর্কে: এই হাদীসের রাবী হল সুলাইমান ইবনে হাইয়ান। ইবনে মঈন আর ইবনে আদী (আহলে সুন্নতের রেজাল শাস্ত্রের আলেম) তার সম্পর্কে বলেন: সুলাইমান সত্যবাদী কিন্তু তার বর্ণনা করা হাদীস ‘হুজ্জত’ গ্রহণযোগ্য নয় তার কারণ তার স্মরণশক্তি ভাল ছিল না আর সে হাদীসগুলোকে সঠিকভাবে বর্ণনা করত না। যদি এই হাদীসের সনদকে মেনেও নেওয়া যায় তবুও অর্থগত ভাবে এর উদ্দেশ্য হল ঐরুপ করা মকরূহ বা অপছন্দীয় বা শিরক ও কুফুরির কারণ এটা হতে পারে যে, যে বস্তু বা বিষয়ের (ব্যক্তি) নামে কসম করা হচ্ছে তার সম্পর্কে আল্লাহর অনুরুপ গুনের বিশ্বাস রাখা।

এসম্পর্কে কাসতালানী বলেন : আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা থেকে বিরত থাকা সম্পর্কে যে শিরক ও কুফুরির কথা বলা হয়েছে এটি অতিরিক্তও বাড়াবাড়ি অর্থ বুঝাতে ব্যবহুত হয়েছে যাতে সবাই তা থেকে বিরত থাকে (সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম অর্থ নয়)। এখানে বারন করার উদ্দেশ্য কি মানায়ে তাহরিমি (منع تحریمی) হারাম বা অবৈধ হওয়ার কারণে নিষেধ করা হয়েছে, না কি কারাহাতি (منع کراحتی) মাকরূহ বা অপছন্দ হওয়ার কারণে মানা করা হয়েছে?

বিখ্যাত মালেকি আলেমরা লেখেন: এ বারনটি মাকরূহ বোঝাতে ব্যবহুত হয়েছে। কিন্তু হাম্বালীগণ হারাম হওয়াকে বর্ণনা করে। আবার অধিকাংশ শাফেয়ী আলেম  মকরূহ বা অপছন্দ মনে করেন আবার কিছু দু ধরনের শ্পনের মধ্যে পার্থক্য করেছেন: তাদের কথা হল যে, যদি সেই বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর শপথ করা হয় সেরূপ বিশ্বাসের সাথে আল্লাহ ছাড়া অন্যের শপথ করা হয় তাহলে এটি হারাম বা কুফরী হবে। আর যদি শুধুমাত্র সৃষ্টির সম্মানের জন্য হয় তাহলে কুফরী হবে না। [25]

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

[1] (আস সেরা বাইনাল ইসলামে ওয়াল উসনিয়া খ: ১ পৃ: ৫৪)

[2] (রিসালায়ে যিয়ারাতুল কুবুর পৃ:২৭, কাশফুল ইরতিয়াব পৃ:২৮৩)

[3] (আল মিলাল ওয়াল নেহাল পৃ২৯১)

[4] (আল মোজামুল বুলদান খ:১ পৃ:৫০৫)

[5] (সনানে আবু দাউদ খ:৩ পৃ২৩৮ হাদীস ৩৩১৩)

[6] (সহীহ বখারী খ:১ পৃ:১)

[7] (ফুরকানুল কুরআন পৃ: ১৩৩)

[8] (ফুরকানুল কুরআন পৃ: ১৩৩)

[9] (সুলহুল ইখওয়ান পৃ: ১০৯, আল গাদির খ:৫ পৃ: ১৮২)

[10] (আল মওয়াহেবুল লাদুন্নিয়া খ:৫ পৃ: ৩৬৪, শাযরাতুয যাহাব খ: ৭ পৃ: ৩৪৬)

[11] (নেইলুল ইবতেহাজ খ:২ পৃ:৬২, আল গাদির খ:৫ পৃ: ২০৪)

[12] (নেইলুল ইবতেহাজ খ:২ পৃ:৬২, আল গাদির খ:৫ পৃ: ২০৪)

[13] (সুলহুল ইখওয়ান পৃ: ১০৯)

[14] (রেসায়েলুল হেদায়াহ : পৃষ্ঠা ২৫)

[15] (কাশফুল ইরতেয়াব : পৃ: ২১৯)

[16] (সহীহ মুসলিম খ:৪ পৃ:৭১৬)

[17] (সহীহ মুসলিম খ:২ পৃ:৭১৬, সনানুল কুবরা খ:২ পৃ:৬১)

[18] (এরশাদুস সারি খ: ৯ পৃ: ৩৫৭)

[19] (কাশফুল ইরতেয়াব পৃ: ২৭২)

[20] (কাশফুল ইরতেয়াব পৃ: ২৭২)

[21] (ইমানে আবুতালিব পৃ:৩৩৯, মুনিয়াতুর রাগিব ফি ইমানে আবুতালিব পৃ:১২২, সংকলন আয়াতুল্লাহ মুহম্মাদ রেযা তাবসী; শারহে ইবনে আবিল হাদিদ খ:১৪ পৃ:৭৯)

[22] (শারহে ইবনে আবিল হাদিদ খ:১৫ পৃ:৭৩)

[23] (শারহে নাহজুল বালাগা, মুহম্মাদ আব্দোহু খ:৩ পৃ৭)

[24] (ইরশাদুস সারি খ : ৯ পৃ : ৩৫৮, সনানে তিরমিযী খ : ৪ পৃ : ১১০)

[25] (ইরশাদুস সারি খ:৯ পৃ:৩৫৮)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।