বি ইসমেহি তায়ালা
শাফাআত
شفاعت
تالیف و ترجمه : مجید الاسلام شاه
সংকলন ও অনুবাদ
মজিদুল ইসলাম শাহ
সূচিপত্র
মুসলমান এবং শাফাআতের বিশ্বাস: 1
হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জন্মের পূর্বে তাঁর কাছে শাফাআত চাওয়া: 6
হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জীবনে শাফাআত চাওয়া: 7
হযরত মুহম্মাদ (স:)এর মৃত্যুর পর তাঁর কাছে শাফাআতের সুপারিশ করা: 8
১– হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে হযরত আলী(আ🙂এর শাফাআত চাওয়া: 8
২– হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে হযরত আবুবকরের শাফাআত চাওয়া: 9
৩– সাহাবীদের সমাবেশে একজন মরুবাসী আরবের শাফাআত চাওয়া: 9
শাফাআত সম্পর্কে ওহাবীদের মতামত: 13
শাফাআত
শাফাআত কি? শাফাআতের সঠিক অর্থ হল একটি শাস্তি অধিকারী মানুষের জন্য দোয়া করা। শুধু তাই নয় নিজের লাভের জন্য সুপারিশ করাকেও শাফাআত বলা হয়।
শাফাআতের সঠিক অর্থ হল একজন আসামির অপরাধকে ক্ষমা করার জন্য সুপারিশ করা, এই কথায় সমস্ত আলেমগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ কিছু আলেমগণের নাম নিম্নে দেওয়া হল:
(১) শেখ তুসি(র:)থেকে বর্ণিত: আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত মুহম্মাদ (স:) সমস্ত মুমিনকে শাফাআত করবেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর শাফাআতকে গ্রহণ করবেন, যার ফলে নামাযী গুনাহগারদের থেকে শাস্তি মোচন করে দেওয়া হবে।[1]
আমাদের বিশ্বাস আল্লাহ তায়ালার নিকট হযরত মুহম্মাদ (স:) ইমামগণ ও বহু সাহাবী মুমিনদের শাফাআত করবেন। [2]
(২) আবু হাফস নাসাফী: একজন আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট আলেমও এই উক্তিতে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন যে, নবীগণ ও সালেহীন গুনাহগার ব্যক্তিদের জন্য শাফাআত করবেন একথা রেওয়ায়েতে বর্ণনা করা হয়েছে। [3]
মুসলমান এবং শাফাআতের বিশ্বাস:
একটি তদন্তের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট হল যে, সমস্ত মুসলমান শাফাআতের বিশ্বাসী। এ সম্পর্কে দুই ভাবে আলোচনা করা হয়েছে:
(১) কাযি আইয়ায থেকে বর্ণিত: আহলে সুন্নত শাফাআতকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে জায়েয মনে করে এবং শরিয়তের দিক থেকে ফরয বলে জানেন এবং ফরয হওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন কুরআন শরিফের এই আয়াত থেকে:
يَوْمَئذٍ لَّا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَانُ وَ رَضىَِ لَهُ قَوْلً
সেদিন কারও সুপারিশ কাজে আসবে না, তবে তার ব্যতীত যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দান করেছেন এবং তিনি তার কথায় সন্তুষ্ট হবেন। [4]
দ্বিতীয় একটি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে:
يَعْلَمُ مَا بَينَْ أَيْدِيهِمْ وَ مَا خَلْفَهُمْ وَ لَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضىَ وَ هُم مِّنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ
যা তাদের সম্মুখে আছে এবং যা তাদের পশ্চাতে আছে, তা সবই তিনি অবহিত এবং তারা ঐ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও জন্য সুপারিশ করে না যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা স্বয়ং তাঁর ভয়ে সতত শংকিত।[5]
এছাড়াও অনেক আয়াত আছে যা থেকে শাফাআতের ফরয হওয়া পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায়, এছাড়া বিভিন্ন রেওয়ায়েতের মধ্যে আছে এবং হযরত মুহম্মাদ (স:) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, কেয়ামতের দিন হযরত মুহম্মাদ (স:) গুনাহগার মুমিনদের শাফাআত করবেন। এবং আহলে সুন্নতের সমস্ত আলেমগণ ইসলামের প্রথম যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সবাই এই উক্তিটির সঠিক হিসেবে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন। [6]
(২) নাসিরুদ্দীন মালেকি থেকে বর্ণিত: যে ব্যক্তি শাফাআতকে অস্বীকার করে তার জন্য এটাই ভাল যেন তাঁর সাথে শাফাআতকে শামিল না করা হয়, কিন্তু যে ব্যক্তি আহলে সুন্নতের মতো শাফাআতের প্রতি ঈমান রাখে এবং তা প্রমাণিত করে তাঁরা আল্লাহর রহমতের আশা রাখে ও বিশ্বাসী যে শাফাআত গুনাহগার মুমিনদের জন্য…যেমন ভাবে হযরত মুহম্মাদ (স:) বলেছেন: আমি শাফাআতকে আমার উম্মতের ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের জন্য যত্ন করে রেখেছি যারা কাবিরা গুনাহতে লিপ্ত হয়েছে। [7]
শাফাআতের প্রকার:
শাফাআতের তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করে শাফাআতকে কয়েক প্রকারে ভাগ করা হয়েছে:
(১) কেয়ামতের দিনে শাফাআত: শাফাআতের এই প্রকারের অর্থ হচ্ছে নবীগণ, ইমামগণ, শহীদগণ, এবং সালেহীন, তাঁরা আল্লাহ এবং বান্দাদের মধ্যে মাধ্যমস্বরূপ। যার ফলে গুনাহগার মুমিনদের গুনাহকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সমস্ত মুসলমান শাফাআতের এই প্রকারকে গ্রহণ করেছেন এমনকি ওহাবীরাও।
(২) দুনিয়ায় শাফাআত চাওয়া: শাফাআতের এই অংশে আমরা এই দুনিয়ায় নবীগণ, ইমামগণ এবং আল্লাহর ওলিদের কাছে সুপারিশের দোয়া করি যেন তাঁরা কেয়ামতের দিনে আমাদের শাফাআত করেন। শাফাআতের এই অংশও সমস্ত মুসলমানের নিকটে গ্রহণীয়, কিন্তু ওহাবীরা এই অংশটিকে অমান্য করে এবং বহুত্ববাদ অর্থাৎ শিরক বলে বর্ণনা করেছে।
শাফাআতের প্রথম অংশকে দুটি দলিল দ্বারা প্রমাণ করা যায়: ১- পবিত্র কোরআনের আলোকে: কোরআনের এই আয়াতটি এই ভাবে বর্ণনা হয়েছে:
وَ مِنَ الَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ عَسىَ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا محَّْمُودًا
এবং রাতের একাংশে তাহাজ্জুদ-নামায আদায় কর, এটা (এ সুন্নাত) তোমার জন্য অতিরিক্ত (ইবাদাতস্বরূপ); অনতিবিলম্বে তোমার প্রতিপালক (এরূপ) তোমাকে প্রশংসিত স্থানে পৌঁছে দেবেন । [8]
মোফাস্সিরগণ এই আয়াতে যে ‘মকামে মাহমুদ’ শব্দটি এসেছে তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, এর অর্থ হচ্ছে শাফাআতের স্থান। দ্বিতীয় আয়াতের মধ্যে বর্ণনা করেছেন:
وَ لَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَترَْضىَ
তোমার প্রতিপালক তোমাকে এতটা দান করবেন যে, তুমি সন্তুষ্ট হবে”। [9]
২- হাদীসের আলোকে: যেমন ভাবে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছিল যে শাফাআত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে যার মধ্যে থেকে শুধু দুইটি হাদীসকে তুলে ধরা হল। প্রথম হাদীস হযরত মুহম্মাদ (স:) থেকে বর্ণিত:
اعطیت خمسا…و اعطیت الشفاعة، فآدّخرتها لامتی لمن لا یشرک بالله شیئا
“আল্লাহ তায়ালা আমাকে পাঁচটি বিশেষ সুবিধা বা অধিকার দিয়েছেন …যার মধ্যে থেকে একটি হল শাফাআত যাকে আমি আমার সেইসব উম্মতের (লোকেদের) জন্য যত্ন করে রেখেছি যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না”। [10]
দ্বিতীয় হাদীস: হযরত মুহম্মাদ (স:) থেকে বর্ণিত: انا اوّل شافع و اوّل مشفع
“আমি সর্ব প্রথম শাফাআতকারী আর আমার শাফাআত সর্ব প্রথম আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে”। [11]
ওলামায়ে ইসলাম শাফাআত সম্পর্কে নিজেদের ধারণাকে এই ভাবে বর্ণনা করেছেন:
(১) শেখ মুফিদ থেকে বর্ণিত: বারো ইমামী শিয়াগণ ঐক্যমত যে, হযরত মুহম্মাদ (স:) কেয়ামতের দিন এমন একটি দলের লোকেদের শাফাআত করবেন যারা গুনাহে কাবিরায় লিপ্ত ছিল। এছাড়া হযরত আলী(আ:) এবং বাকি ইমামগণও কেয়ামতের দিনে গুনাহগারদের শাফাআত করবেন এবং তাঁদের শাফাআতের মাধ্যমে অনেক গুনাহগার মুক্তি পাবে। (আওয়াইলুল মাকালাত ফিল মাযাহিব ওলমুখতারাত পৃ: ২৯) এই বইয়ের মধ্যে বর্ণনা হয়েছে:
اتفقت الامامیة علی انّ رسول الله صلی الله علیه و اله و سلم یشفع یوم القیامة لجماعة من مرتکبی الکبائر من امته ، و انّ امیرالمومنین علیه السلام یشفع فی اصحابه الذنوب من شیعته ، و انّ ائمة آل محمد علیهم السلام کذالک. و ینجی الله بشفاعتهم کثیرا من الخاطئین.
أوائل المقالات في المذاهب والمختارات ، ص 29 تحقيق مهدي محقق .
(২) আল্লামা মজলিসী(র:) থেকে বর্ণিত: সমস্ত মুসলমান এই উক্তিতে ঐক্যমত যে, শাফাআত দ্বীন ইসলামের প্রয়োজনীয় বিষয়, এর অর্থ হল হযরত মুহম্মাদ (স:) শুধু মাত্র নিজের উম্মতের জন্য নয় বরং সমস্ত নবীগণের উম্মতদের শাফাআত করবেন। [12]
(৩) ফাখরে রাযি থেকে বর্ণিত: সমস্ত মুসলিম উম্মত একথায় ঐক্যমত যে হযরত মুহম্মাদ (স:) কেয়ামতের দিন শাফাআতের অধিকার রাখেন, এবং আল্লাহ তায়ালার এই আদেশও এ কথাকে প্রমাণ করে।
(عَسىَ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا محَّْمُودًا) এবং ( وَ لَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَترَْضىَ)
তোমার প্রতিপালক তোমাকে এতটা দান করবেন যে, তুমি সন্তুষ্ট হবে। [13]
অনতিবিলম্বে তোমার প্রতিপালক (এরূপ) তোমাকে প্রশংসিত স্থানে পৌঁছে দেবেন । [14]
(মাফাতিউল গায়েব ৩:৫৫) এর মধ্যে এই ভাবে বর্ণিত হয়েছে:
(اجمعت الامة علی انّ لمحمد صلی الله علیه و اله شفاعة فی الاخرة و حمل علی ذلک قوله تعالی: عسی ان یبعثک ربّک مقاما محمودا او قوله تعالی: ولسوف یعطیک ربّک فترضی)
(৪) আবুবকর কালাবাযি (মৃত্য ৩৮০ হিজরী) থেকে বর্ণিত: আলেমগণ ঐকমত্য যে, হযরত মুহম্মাদ (স:) শাফাআত সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তাঁর উপর বিশ্বাস রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন এবং ফরয। তাঁর কারণ, আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের মধ্যে বলছেন: (তোমার প্রতিপালক তোমাকে এতটা দান করবেন যে, তুমি সন্তুষ্ট হবে) [15]
বিস্ময়কর বিষয় এই যে, ইবনে তাইমিয়া এবং আব্দুল ওহাবও এই শাফাআতে বিশ্বাসী, তা তারা অস্বীকার করেন না। [16]
দুনিয়ায় শাফাআত:
পবিত্র নবীগণ ইমামগণ এবং পূন্যবান ব্যক্তিবর্গের কাছে এই দুনিয়ায় শাফাআতের জন্য আবেদন করা জায়েয, কারণ হযরত মুহম্মাদ (স:) থেকে উক্ত বিষয় সম্পর্কে বহু হাদীস ও রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যার ফলে কোনো রকম সন্দেহ অবশিষ্ট থাকে না, তাঁর কারণ হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জন্মের পূর্বে, তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর তার নিকট শাফাআতের আবেদন করার অনেক উদাহরণ ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায় এবং স্বয়ং রসূল (স:)কে আল্লাহ স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাছাড়া রসূল (স:)এর সাহাবীগণ তাঁর মৃত্যুর পর এই ধরনের শাফাআত চেয়েছিলেন আর তাঁর সামনে শাফাআত চাওয়া হয়েছিল এবং রসূল (স:) তা নিষেধও করেন নি।
হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জন্মের পূর্বে তাঁর কাছে শাফাআত চাওয়া:
গ্রহণযোগ্য ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তাবআ বিন হাস্সান হিময়ারী’ হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জন্মের হাজার বছর পূর্বে একটি পত্রের মাধ্যমে শাফাআতের সুপারিশ করেছিল যখন এই পত্র হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে পৌঁছালো তখন তিনি অনুমোদন করলেন এবং বললেন:
(مرحبا بتبع الاخ الصالح) …এই ব্যাখ্যাটি শাফাআতের এবং তার থেকে সন্তুষ্ট হওয়াকে প্রমাণ করছে, আসল ঘটনাকে ইমাম সাদিক(আ:)এর যুগের একজন ব্যক্তি ইবনে ইসহাক নিজের পুস্তক ‘আল মাবদা ওয়া কাসাসুল আম্বিয়া’ এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন এবং হালাবীও (মৃত্যু ১০৪৪ হিজরী) নিজের পুস্তক ‘আল সিরাতুল হালাবিয়ায়’ ইবনে ইসহাক থেকে বরাত দিয়ে লিখেছেন।
তাবআ বিন হাস্সান পত্রের মধ্যে এই ভাবে লিখেছে: হে মুহম্মাদ আমিন, তোমার আল্লাহ যার অধিনে সমস্ত মাখলুকাত আছে, তাঁর উপর, যা তোমার উপর নাযিল হয়েছে, এবং তার সমস্ত আইনের উপর ঈমান রাখি যদি তোমার রেসালতের যুগ পেয়ে যাই তাহলে খুব ভালো আর যদি না পাই তাহলে তোমার কাছে আবেদন করছি যেন তুমি আমার জন্য শাফাআত করতে ভুলো না।
ইবনে ইসহাক আরও লিখেছেন: আবি লায়লা বংশের একজন জ্ঞানী ব্যক্তি মদিনার দিকে হিজরত করার সময় এই পত্রটা হযরত মুহম্মাদ (স:)এর দরবারে নিয়ে এসেছিলেন হযরত মুহম্মাদ (স:) পত্র হাতে নেওয়ার পর তিন বার বলেছিলেন: (مرحبا بتبع الاخ الصالح)
হালাবী এটাও বলেছে যে, তাবআ বিন হাস্সানের এই পত্র এবং হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জন্মের মধ্যে এক হাজার বৎসরের তফাৎ ছিল। [17]
এখানে একটা প্রশ্ন জাগে যে, যদি পৃথিবীতে শাফাআত চাওয়া বহুতত্ত্ববাদ (শিরক) হতো তাহলে রসূল (স:)কেন এই বহুতত্ত্ববাদ (শিরক) এর মত যেমন নোংরা কাজকে অনুমোদন করলেন? এবং যে ব্যক্তি পত্রটা পাঠিয়ে ছিল তাকে ভাই বলেছেন!
রসূল (স:)কি একজন মুশরিক ব্যক্তিকে ভাই বলে সম্বোধন করতে পারেন?!
হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জীবনে শাফাআত চাওয়া:
হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জীবিত থাকা কালিন অবস্থায় যদি রেওয়ায়েতগুলোকে দেখা যায়, তাহলে বুঝতে পারবো যে, সাহাবীগণ হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে শাফাআতের আবেদন করতেন। উদাহরণ-স্বরূপ শুধু দুটি রেওয়ায়েত বর্ণনা করছি:
১- আনাস(র:) থেকে বর্ণিত: আনাস(র:)বলেন: আমি হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে সুপারিশ করেছিলাম যে, তিনি যেন কেয়ামতের দিন আমার শাফাআত করেন। হযরত মুহম্মাদ আমার সুপারিশকে গ্রহণ করলেন এবং বললেন: আমি শাফাআত করবো। আমি বললাম: সেই দিন আমি আপনার সাথে কোন স্থানে সাক্ষাৎ করবো? বললেন: পুলে সেরাতের পাশে, আমি বললাম: যদি আপনাকে ওখানে না পাই তাহলে? বললেন: মিযানের পাশে, আমি আবার বললাম: যদি ওখানেও না পাই? বললেন: হাউযের পাশে, তার কারণ আমি এই তিনটি স্থান ছাড়া অন্য কোথাও যাবো না।[18]
২- সাওয়াদ বিন কারিব থেকে বর্ণিত: রেওয়ায়েতে পাওয়া যায় যে, সাওয়াদ বিন কারিব এক দিন হযরত মুহম্মাদ (স:) দরবারে উপস্থিত হলেন এবং কবিতা পড়ে শাফাআত চাওয়ার সুপারিশ করে বললেন:
و کن لی شفیعا یوم لا ذو شفاعة سواک بمغن فتیلا عن سواد بن قارب
হে মুহম্মাদ! কেয়ামতের দিন আমার শাফাআত করবেন, সেই দিন যে দিন কারোর শাফাআত আমার জন্য খোরমার পরিমাণ কাজে আসবে না। [19]
হযরত মুহম্মাদ (স:)এর মৃত্যুর পর তাঁর কাছে শাফাআতের সুপারিশ করা:
প্রথমে বলা হয়েছে যে, শাফাআত শুধু হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জীবনে সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর মৃত্যুর পরেও সাহাবাগণ শাফাআতের সুপারিশ করেছেন। উক্ত বিষয়ের উপর কিছু রেওয়ায়াত বর্ণনা করছি:
১– হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে হযরত আলী(আ🙂এর শাফাআত চাওয়া:
মুহম্মাদ বিন হাবিব বলেছেন: যখন হযরত আলী(আ:) হযরত মুহম্মাদ (স:)কে গোসল ও কাফন দেওয়া সর্ম্পূন করে তাঁর চেহারা মোবারক থেকে কাফন সরানো অবস্হায় বললেন:
بابی انت و امّی طبت حیّا و طبت میّتا بابی انت و امّی اذکرنا عند ربّک
আমার মা বাবা আপনার উপর উৎসর্গ হউক আপনি পাক ও পবিত্র জীবন যাপন করেছেন এবং পাক ও পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর দরবারে ফিরে যাচ্ছেন…আমার মা বাবা আপনার উপর উৎসর্গ আমাকে নিজের আল্লাহর দরবারে স্মরন রাখবেন। [20]
২– হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে হযরত আবুবকরের শাফাআত চাওয়া:
হযরত আয়েশা (র:) থেকে বর্ণিত: যখন হযরত মুহম্মাদ (স:)এর মৃত্যুর খবর আবুবকরের কাছে পৌঁছালো…তখন আবুবকর নিজেকে হযরত মুহম্মাদ (স:)এর শরীরের উপর ফেলে দিয়ে, চেহারা মোবারক থেকে কাপড় সরিয়ে মুখে কপালে হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন: হে মুহম্মাদ! আমাকে আপনার আল্লাহর দরবারে স্মরন রাখবেন। [21]
৩– সাহাবীদের সমাবেশে একজন মরুবাসী আরবের শাফাআত চাওয়া:
আহমাদ যিনি দেহলান (হারামায়নের ইমাম) উক্ত বিষয়ের ব্যাপারে ইবনে হাজার আসকালানি থেকে বরাত দিয়ে রেওয়ায়েত করেছেন যে, হযরত আলী (আ:) বলেছেন: হযরত মুহম্মাদ (স:)এর দাফনের তিন দিন পরে একজন বেদুইন মদিনায় এল এবং হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কবরে গিয়ে নিজেকে কবরের উপর ফেলে কবরের মাটি মাথায় দিয়ে বলতে লাগলো: হে রসূল আল্লাহ ! আপনি আপনার জীবনে কিছু কথা বলেছিলেন, আমি সেগুলোকে গ্রহণ করেছি যেমন ভাবে আপনি ইসলাম ধর্মের বিধান আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন ঠিক সেই ভাবে আমিও সেই বিধান আপনার কাছ থেকে নিয়েছি, ঐ আয়াত যা আল্লাহ তালা আপনার উপর অবতীর্ণ করেছেন তার মধ্যে থেকে একটা এটা:
وَ لَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُواْ أَنفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُواْ اللَّهَ وَ اسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُواْ اللَّهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا
এবং (হে রসূল!) যখন তারা (অবাধ্যতা করে) নিজেদের (আত্মার) প্রতি অবিচার করেছিল, যদি তোমার নিকট আসত এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত আর রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইত, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে অতিশয় ক্ষমাশীল, অনন্ত করূণাময় পেত। [22]
হে আল্লাহর রসূল! আমি নিজের উপর অন্যায় করেছি আর আপনার দরবারে এসেছি যাতে আপনি আমার মাগফেরাতের দোয়া করেন। ঐ সময় রসূল (স:)এর কবর থেকে আওয়াজ আসল যে, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন। [23]
নবীগণ (আ:)এর জীবন:
কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর নবীগণ এবং বিশেষ করে হযরত মুহম্মাদ (স:) মৃত্যুর পর অমর জীবনের মালিক। সব কিছু দেখেন ও শোনেন শুধু তাই নয় সমস্ত উম্মতের আমল তাঁর সম্মুখে পেশ করা হয়। তাঁর এই জীবন শহীদদের জীবনের থেকে অনেক উচ্চ, কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই নবুওতের স্থান শাহাদতের স্থান থেকে অনেক উচ্চ। এখান থেকে বোঝা যায় যে, হযরত মুহম্মাদ (স:) এর মৃত্যুর পর তাঁর কাছে শাফাআত চাওয়া কোনো মৃত মানুষের কাছে শাফাআত চাওয়া নয়। এই উক্তি সর্ম্পকে কয়েকজন আলেম ও চিন্তাবিদদের মতামত এখানে তুলে ধরছি:
১- কাসতালানি বলছে:
(لا شکّ انّ حیاة الانبیاء علیهم الصلاة و السلام ثابتة معلومة مستمرّة و نبیّنا افضلهم واذا کان کذالک فینبغی ان تکون حیاته اکمل و اتمّ من حیاة سائرهم)
“কোনো সন্দেহ নেই যে নবীগণের মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকেন আর প্রমাণিত, সুস্পষ্ট ও চিরন্তন একটি বিষয় যেহেতু আমাদের নবী সমস্ত নবী থেকে উত্তম, যেহেতু হযরত মুহম্মাদ (স:)এর জীবনও মৃত্যুর পরে অন্যান্য সমস্ত নবী থেকে পূর্ণতর হবে”। [24]
২- শাওকানি নিজের পুস্তক ‘নায়লুল আওতার’ ফাসল ‘সালাতুল মাখলুকাত আলাননবী ওয়া হুয়া ফি কাবরেহি হায়য়ায়’ লিখেছেন:
(و قد ذهب جماعة من المحققین الی انّ رسول الله صلی الله علیه و اله و سلم حیّ بعد و فاته و انّه یسرّ بطاعات امته ، و انّ الانبیاء لا بیلون ، مع انّ مطلق الدراک کالعلم و السماع ثابت لسائر الموتی ، وورد النصّ فی کتاب الله فی حقّ الشهداء انّهم احیاء یرزقون و انّ الحیاة فیهم متعلقة بالجسد، فکیف بالانبیاء و المرسلین و قد ثبت فی حدیث :(انّ الانبیاء احیاء فی قبورهم) و رواه المنذری و صححه البیهقی)
“গবেষকদের একটি দল বলেন: হযরত মুহম্মাদ (স:) মৃত্যুর পরেও বেঁচে আছেন এবং নিজের উম্মতের অনুস্মরণকে দেখে আনন্দিত হন। নবীগণের শরীর কবরের মধ্যে পচে না অবশ্য সকল প্রকার বোধশক্তি যেমন জ্ঞান ও শোনার শক্তি মৃত ব্যক্তির প্রমাণিত এবং পবিত্র কোরআনে এবিষয়ে পরিষ্কার দলিল আছে যে, শহীদরা বেঁচে আছেন এবং আল্লাহর নিকট থেকে দৈনিক রিযিক লাভ করেন তাঁদের রুহ তাঁদের শরীরের সঙ্গে জুড়ে আছে, যদি শহীদগণ এরকম হতে পারে, তাহলে নবীগণ আর রসূলদের ক্ষেত্রে এটা হওয়া অধিকতর আরো স্বাভাবিক ও উচিত। কারণ, নবীগণের সম্মান ও মার্যাদা শহীদদের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে, তাই আবশ্যিক ভাবে তাঁদের আত্মা তাঁদের শরীরের সঙ্গে জুড়ে আছে”।
ইবনে হাজার হায়সামি নিজের পুস্তকে আবদুল্লাহ বিন মাসউদ থেকে বর্ণনা করছে:
(حیاتی خیرلکم تحدثون و یحدث لکم، ووفاتی خیرلکم، تعرض علیّ اعلمالکم فما رایت من خیر حمدت الله علیه و ما رایت من شرّ استغفرت الله لکم)
“আমার জীবন তোমার জন্য বরকতের কারণ এবং আমার মৃত্যুও, তোমাদের আমল আমার সম্মুখে উপস্থিত করা হয়। যখন তোমাদের ভাল আমল দেখি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই আর যখন খারাপ আমল দেখি তখন তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করি”।
ইবনে হাজার এই হাদীসের সত্যতার জন্য লিখছেন যে, এই হাদীসের বর্ণনাকারী তারা যারা সহীহ বোখারী ও সহীহ মুসলিমে হাদীস বর্ণনা করেছেন। [25]
মুসলিম নিশাবুরীও নিজের পুস্তকে উক্ত বিষয় সম্পর্কে হযরত মুহম্মাদ (স:)এর হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মুহম্মাদ বলছেন:
مررت علی موسی لیلة اسری بی عند الکثیب الاحمر و هو قائم یصلی فی قبره
“আল্লাহর রসূল (স:) বললেন: আমি যে রাত্রে মিরাজে গিয়েছিলাম, সেই রাত্রে যখন মূসা(আ:)এর পাশ দিয়ে পরিভ্রমণ করেছিলাম অর্থাৎ লাল বালুকাস্তূপের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই সময় দেখি তিনি নিজের কবরের মধ্যে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিলেন”। [26]
কুরআনের আলোকে ইস্তেগফার:
ইস্তেগফার সম্পর্কে কোরআনে বহু আয়াত আছে যার মধ্যে থেকে কয়েকটি আয়াত বর্ণনা করছি:
১- আমরা সূরায়ে মুনাফেকুনের মধ্যে পড়ে থাকি:
وَ إِذَا قِيلَ لهَُمْ تَعَالَوْاْ يَسْتَغْفِرْ لَكُمْ رَسُولُ اللَّهِ لَوَّوْاْ رُءُوسَهُمْ وَ رَأَيْتَهُمْ يَصُدُّونَ وَ هُم مُّسْتَكْبرُِونَ
যখন তাদের বলা হয়, ‘তোমরা এস, আল্লাহর রসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন’, তখন তারা তাদের মাথা ফিরিয়ে নেয় এবং তুমি তাদের দেখবে যে, তারা দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। [27]
আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের মধ্যে হযরত মুহম্মাদ (স:) কে বলছেন: শাফাআত থেকে মুখ ফিরানো নেফাকের চিহ্ন, তাহলে এর বিপরীত অর্থে দুনিয়ায় শাফাআত চাওয়া এবং সুপারিশ করা ঈমানের চিহ্ন।
২- সুরা নিসায় বর্ণিত হয়েছে:
وَ لَوْ أَنَّهُمْ إِذ ظَّلَمُواْ أَنفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُواْ اللَّهَ وَ اسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُواْ اللَّهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا
এবং (হে রসূল!) যখন তারা (অবাধ্যতা করে) নিজেদেরে (আত্মার) প্রতি অবিচার করেছিল, যদি তোমার নিকট আসত এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত আর রসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইত, তবে তারা আল্লাহকে অতিশয় ক্ষমাশীল, অনন্ত করূণাময়ী পেত । [28]
এই আয়াতটিও হযরত মুহম্মাদ (স:)এর কাছে শাফাআতের সুপারিশ করাকে পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করছে, যা সত্যিকারে ঐ শাফাআত চাওয়া।
শাফাআত সম্পর্কে ওহাবীদের মতামত:
ওহাবী গোষ্ঠীদের মতামত হল যে, দুনিয়ায় শাফাআত চাওয়া হারাম। মুহম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব বলেন:
(من جعل بینه و بین الله وسائط یدعوهم و یسالهم الشفاعة کفر اجماعا)
“যে ব্যক্তি নিজের এবং খোদার মাঝখানে মাধ্যম বানায় এবং আল্লাহকে ডাকে ও শাফাআত চায় সে ব্যক্তি ইজমা ফতোয়ার অনুসারে কাফির হয়ে যায়”। [29]
সর্বপ্রথম আমরা ওহাবীদের মতামতকে বাতিল করার জন্যে নিজেদের মতামতের উপর মজবুত দলিল নিয়ে আসবো তার পর বিবেক ও জ্ঞান দ্বারায় তাঁদের মতামতকে বাতিল করবো।
এ ব্যাপারে ওহাবীরা দুই দিক থেকে অক্ষম ও দুর্বল, এখন আমরা শুধু তাঁদের দলিলকে বর্ণনা করবো।
সর্বপ্রথম আয়াত যা থেকে ওহাবীরা দলিল পেশ করে সেটি হল এই যে, আল্লাহ তায়ালা বলছেন:
وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللّهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـؤُلاء شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللّهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
এবং তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা করে তারা না তাদের ক্ষতি করতে পারে, আর না উপকার করে। আবার বলে, ‘আল্লাহর নিকট এরাই আমাদের সুপারিশকারী’। তুমি বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ের খবর দিতে চাও যার জ্ঞান আসমান-জমিনে কোথাও তিনি পান না? তোমরা যাদের তাঁর অংশী কর তা হতে তিনি পাক-পবিত্র এবং ঊর্ধ্বে । [30]
মুহম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব এই আয়াত থেকে প্রমাণ করছে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের মধ্যে খবর দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি অন্য কাউকে আল্লাহ এবং নিজের মধ্যে মাধ্যম বানাবে সে আসলে ঐ ব্যক্তির ইবাদত করলো এবং তাকে আল্লাহর সমতুল্য বানালো।
উক্ত মতামতের উত্তর:
আমরা এই মতামতের উত্তরে বলবো যে, এই আয়াত থেকে এই ধরনের অর্থ করা আশ্চর্যজনক এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা রটানোর একটি উজ্জল উপমা বা দৃষ্টান্ত। এই আয়াতের মধ্যে কোথায় বলা হয়েছে যে, আল্লাহ এবং নিজের মধ্যে মাধ্যম বানানো শিরক? এই ধরনের অর্থ এই আয়াত থেকে বোঝা যায়:
قُلْ آللّهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى اللّهِ تَفْتَرُونَ
বল, আল্লাহ কি তোমাদের এটার অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করছ? [31]
কারণ আয়াতের অক্ষরেখা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করা, কিন্তু এটা নয় যে, কাউকে মাধ্যম বানানো, আয়াত থেকে এই ধরনের অর্থ নেওয়া নিজের দাবীকে প্রমাণ করার জন্য এক ধরনের ভ্রমাত্মক যুক্তি প্রদর্শন বা মানুষকে ভুল বোঝানো, এছাড়া অন্য কিছু নয়। তাঁর কারণ যারা নবীগণ ইমামগণ ও সালেহীনকে মাধ্যম বানায় তাঁরা তাদের ইবাদত করে না।
তাছাড়া এই আয়াতের শানে নুযুলও এটাই বর্ণনা করে যে, যাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে, তাঁরা সেই সব জাতি যারা মাধ্যমদের ইবাদত করতো। কিছু নমুনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি:
১- জালালুদ্দিন সূয়ুতী লিখেছেন: নাযর যে মুশরিক ছিল বলছে: কেয়ামতের দিন লাত ও উয্যা (মূর্তি) আমার শাফাআত করবে। সেই সময় আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত অবতীর্ণ করলেন:
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللّهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الْمُجْرِمُونَ (17) وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللّهِ مَا لاَ يَضُرُّهُمْ وَلاَ يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـؤُلاء شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللّهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ (18)
তার অপেক্ষা অধিকতর অবিচারক কে হবে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা তার নির্দশনসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? নিশ্চয় অপরাথীরা সফলকাম হয় না।
এবং তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা করে তারা না তাদের ক্ষতি করতে পারে, আর না উপকার করে। আবার বলে, ‘আল্লাহর নিকট এরাই আমাদের সুপারিশকারী’। তুমি বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ের খবর দিতে চাও যার জ্ঞান আসমান-জমিনে কোথাও তিনি পান না? তোমরা যাদের তাঁর অংশী কর তা হতে তিনি পাক-পবিত্র এবং ঊর্ধ্বে’। [32]
২- ইবনে কাসীর এই আয়াতের তাফসীর ও শানে নুযুল সম্পর্কে লিখেছেন: আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে সেই সমস্ত মুশরিকদের সমালোচনা করেছেন যারা তাঁর শরিক বানাতো ও সেগুলোর ইবাদত করতো, তারা এই চিন্তা করতো যে তাদের বানানো মূর্তি, খোদার কাছে তাদেরকে সাহায্য করবে, তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের এই ভুল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বললেন: মূর্তিরা তোমাদের শাফাআত করতে সক্ষম হবে না আর না ক্ষতিকে তোমাদের থেকে দূর করাবে। মূর্তি কোনো জিনিসের মালিক নয় এবং মূর্তিদের সম্পর্কে তাদের ধারনা কখনই বাস্তবরূপ …করবে না। [33]
৩- আবু হাইয়ান আনদুলুসীও নিজের মত প্রকাশ করেছেন: (یعبدون) (ফেল মোযারে) এর (ضمیر) সর্বনাম কাফিরদের দিকে যাচ্ছে আর (مالا یضرهم ولا ینفعهم) এর উদ্দেশ্য মূর্তি যারা না ভাল কিছু করাতে পারে আর না ক্ষতি থেকে দূরে রাখার শক্তি তাদের মধ্যে আছে…তাইফের লোকেরা লাত মূর্তির উপাসনা করতো আর মক্কাবাসীরা উয্যা, মানাত, আসাফা, নাইলা, আর হোবালের উপাসনা করতো। [34]
৪- আলুসী মুশরিকদের এই ধরনের ইবাদতকে অবিচার বলে বর্ণনা করেছেন: এই আয়াত মুশরিকদের আর একটি অবিচারকে বর্ণনা করছে এবং এই শব্দকে আত্ফ করা হয়েছে ১৫ নম্বর আয়াতের উপর যার মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে:
(واذا تتلی علیهم) এই আয়াতটিও মুশরিকদের সম্পর্কে ছিল আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতের ঘটনাকে আগের আয়াতের ঘটনার উপর আত্ফ করেছেন এবং (ما) শব্দ ঐ আয়াতে, মায়ে মাওসুলা বা মাওসুফা যার উদ্দেশ্য মূর্তি, তার দিকে ইশারা করেছেন, এবং ঐ শব্দ (مالا یضرهم ولا ینفعهم) এর অর্থ হচ্ছে মূর্তির মধ্যে শাফাআত করার শক্তি নেই এই কারণে মূর্তি জড় পদার্থ ছাড়া অন্য কোনো জিনিস হতে পারে না।
আলুসী আরও লিখেছেন: তাইফবাসীরা লাত মূর্তির পূজা করত আর মক্কাবাসীরা উজ্জা, মানাত, আসাফা, নাইলা, আর হোবালের পূজা করতো, আর বলতো যে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের শাফাআত করবে।
নাযর বিন হারিস বলেন: যখন কিয়ামত আসবে তখন লাত ও উয্যা মূর্তি আমাদের শাফাআত করবে সেই সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। [35]
আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে শাফাআত চাওয়া হারাম তার প্রমাণ ওহাবীরা এই ভাবে বর্ণনা করেছে:
(المیّت لایملک لنفسه نفعا ولا ضرّا فضلا لمن ساله ان یشفع له الی الله)
“মৃত ব্যক্তি না নিজের লাভের মালিক আর না ক্ষতির। এই অবস্থায় কেউ যদি প্রশ্ন করে তাহলে সে আল্লাহর কাছে কিভাবে শাফাআত করবে?”
আমরা ওহাবীদের এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো, আমরা প্রথমে এই উক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি যে, নবীগণ, ইমামগণ, আর শহীদগণ বেঁচে আছেন এবং আল্লাহর তরফ থেকে খাদ্য লাভ করেন যা তাঁদের জীবিত থাকার সাক্ষ্য বহন করে। বিশেষ করে ওহাবীদের ভুল এই স্থানে, ওরা মনে করে নবীগণের মৃত্যুর পর তাঁদের কাছে শাফাআতের সুপারিশ করা ঠিক ওই ভাবে যেমন ভাবে মৃত ব্যক্তির কাছে শাফাআতের সুপারিশ করা, মনে হয় যেন এরা কোরআনের এই আয়াত পড়েইনি বা অর্থ সম্পর্কে একটুও চিন্তা করেনি বা অন্য আয়াতের মতো এই আয়াতেরও তাফসীর নিজেদের মত অনুযায়ী করেছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন:
(وَ لَا تحَْسَبنََّ الَّذِينَ قُتِلُواْ فىِ سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتَا بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ)
আল্লাহর পথে নিহতদের কখনই মৃত মনে কর না; বরং তারা জীবিত; নিজেদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তারা জীবিকা পেয়ে থাকে।
(فَرِحِينَ بِمَا ءَاتَئهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ وَ يَسْتَبْشرُِونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُواْ بهِِم مِّنْ خَلْفِهِمْ أَلَّا خَوْفٌ عَلَيهِْمْ وَ لَا هُمْ يَحْزَنُونَ)
এবং আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা তাদের দিয়েছেন তাতে তারা আনন্দিত এবং যারা তাদের পশ্চাতে রয়ে গেছে, আর এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি, তাদের সম্বন্ধে এ সুসংবাদ রাখে যে, তাদের না কোন ভীতি থাকবে, আর না তারা দুঃখিত হবে।
(يَسْتَبْشرُِونَ بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَ فَضْلٍ وَ أَنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ)
তারা আল্লাহর পক্ষ হতে প্রাপ্ত নিয়ামত ও তাঁর অনুগ্রহ এবং এ বিষয়ে সুসংবাদ পেয়ে আনন্দিত যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না। [36]
সামহুদি নিজের পুস্তক ‘ওফাউল ওফা বা আহলে দারুল মুস্তাফা’ এর মধ্যে এই রেওয়ায়েতকে বর্ণনা করেছে: যা নবীগণের মৃত্যুর পরে তাঁদের জীবিত থাকাকে সাক্ষ্য বহন করে যথা:
১- (الانبیاء احیاء فی قبورهم یصلّون)
“নবীগণ নিজের কবরে জীবিত আছেন এবং নামায আদায় করেন”।
২- (انّ الله حرّم علی الارض ان تاکل اجساد الانبیاء)
“আল্লাহ তায়ালা নবীদের শরীর নষ্ট করাকে যমিনকে হারাম করেছেন”।
উক্ত বিষয় সম্পর্কে বহু রেওয়ায়েত বর্ণনা হয়েছে, যা থেকে নবীগণের মৃত্যুর পর তাঁদের জীবিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। যা কিছু এই বিষয়ে বর্ণনা হয়েছে তার থেকে বোঝা যায় যে, ওহাবীদের বিশ্বাস মুসলমানদের সেই সুনিশ্চিত বিশ্বাসের বিপরীত যা দশেরও বেশী রেওয়ায়েত ও আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় এই যে, ওহাবীরা এই সমস্ত সুস্পষ্ট ও তীক্ষ্ম প্রমাণগুলোকে প্রত্যাখ্যান বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারবে না সুতরাং ওদের চিন্তাধারা মুসলমানদের চিন্তাধারার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছে তাই আব্দুলকাফি সাবকীর কথা অনুযায়ী
(شذّ عن جماعة المسلمین) ইবনে তাইমিয়া মুসলমানদের দল থেকে বাহির হয়ে গিয়েছে। [37]
তথ্যসূত্র:
১- কুরআন মাজিদ
২- রেসায়েলে মুরতাযা
৩- তাফসীরে তিবয়ান
৪- আল আকায়েদুন নাসফিয়া
৫- শারহে সহি মুসলিম নাওভি
৬- আল ইন্তেসাব ফিমা তাযাম্মানা মানাহুল কাশ্শাফ মিনাল ইতেযাল
৭- মাসনদে আহমাদ
৮- নাসায়ী
৯- সনানে তিরমিযী
১০- বেহারুল আনওয়ার
১১- লেতারেফো মাযহবে আহলুত তাসুফ
১২- মাজমুয়াতুর রেসায়েলুল কুবরা
১৩- আল হাদিয়াতুস সানিয়া, রেসালাতুসসানিয়া
১৪- আসসিরাতুল হালবিয়া
১৫- আল ইসাবাহ
১৬- আল আহাদিসুততাওয়াল তাবরানি
১৭- আল দুরারুসসানিয়া ফি রদ্দে আলাল ওহাবিয়া
১৮- আততামহিদ
১৯- নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ
২০- তামহিদুল আওয়ায়েল ওয়া তালখিসুদ দালায়েল
২১- আল দরারুস্সানিয়া ফি রাদ্দে আলাল ওহাবিয়া
[1]. (রেসায়েলে মুরতাযা: ১: ১৫০, ৩: ১৭)
[2]. (তাফসীরে তিবয়ান: পৃ: ২১৩)
[3]. (আল আকায়েদুন নাসফিয়া: পৃ: ১৪৮)
[4]. (সুরা ত্বাহা আয়াত ১০৯)
[5] (সুরা আম্বিয়া আয়াত ২৮)
[6] (শারহে সহি মুসলিম নাওভি: খ: ৩ পৃ: ৩৫ বাব ইসবাতুশশাফাআত…)
[7] (আল ইন্তেসাব ফিমা তাযাম্মানা মানাহুল কাশ্শাফ মিনাল ইতেযাল: খ: ১ পৃ: ৩১৪)
[8] (সুরা এসরা আয়াত: ৭৯)
[9] (সুরা যোহা আয়াত: ৫)
[10] (মাসনদে আহমাদ: খ: ১ পৃ: ৩০১ নাসায়ী: খ ১ পৃ: ২১১)
[11] (সনানে তিরমিযী: খ: ৫ পৃ: ২৪৮’ বাব ২২’ হাদীস ৩৬৯৫)
[12] (বেহারুল আনওয়ার: খ: ৮ পৃ: ২৯’ ৬৩)
[13] (সুরা যোহা আয়াত: ৫)
[14] (সুরা এসরা আয়াত: ৭৯)
[15] (লেতারেফো মাযহবে আহলুস তাসুফ: ৫৪)
[16] (মাজমুয়াতুর রেসায়েলুল কুবরা: খ:১ পৃ: ৪০৩ ও ৪০৪ , আল হাদিয়াতুস সানিয়া, রেসালাতুসসানিয়া: পৃ: ৪২)
[17] (আসসিরাতুল হালবিয়া: খ: ২ পৃ: ২৭৯)
[18] (সনানে তিরমিযী: ৪: ৬২১ হাদীস ২৪৩৩)
[19] (আল ইসাবাহ খ: ৩ পৃ: ১৮২, ১১০৯, আল আহাদিসুততাওয়াল তাবরানি পৃ:৮৫ হাদীস ৩১, আল দুরারুসসানিয়া ফি রদ্দে আলাল ওহাবিয়া পৃ: ২৭)
[20] (আততামহিদ, ইবনে অব্দুলবার খ: ২ পৃ: ১৬২, শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ খ: ১৩ পৃ: ৪২,হাদীস ২৩)
[21] (তামহিদুল আওয়ায়েল ওয়া তালখিসুদ দালায়েল খ:১ পৃ:৪৮৮)
[22] (সূরা নিসা, আয়াত: ৬৪)
[23] (আল দরারুস্সানিয়া ফি রাদ্দে আলাল ওহাবিয়া পৃ: ২১)
[24] (আল মাওয়াহেবুললাদুনিয়া খ: ৩ পৃ:শ ৪১৩)
[25] (মাজমাউযযাওয়ায়েদ: ৯ : ২৪, আল জামেউসসাগির: ৫৮২, কানযুল উম্মাল ১১:৪০৭)
[26] (সহীহ মুসলিম খ: ৭ পৃ: ১০২ কেতাবে ফাযায়েলে মূসা(আ:) )
[27] (সূরা মুনাফেকুন ৫)
[28] (সূরা নিসা, আয়াত: ৬৪)
[29] (মাজমুআতুল মোয়াললেফাত খ: ১ পৃ: ৩৮৫, এবং খ: ৬ পৃ: ৬৮)
[30] (সুরা ইউনুস ১৮)
[31] (সুরা ইউনুস আয়াত ৫৯)
[32] (সূরা ইউনুস ১৭ও১৮)
[33] (তাফসীরুল কোরআনিল আযীম খ: ২ পৃ: ৬২৪ সুরা ইউনুস)
[34] (তাফসীরুল বাহরুল মুহিত খ: ৫ পৃ ১৩৩ সুরা ইউনুস ১৮)
[35] (তাফসিরে রুহুল মাআনী খ: ১১ পৃ: ৮৮ সুরা ইউনুস ১৮)
[36] (সুরা আলে ইমরান আয়াত ১৬৯,১৭০ও১৭১)
[37] (তাবকাতুশ শাফিয়াতুল কুবরা খ: ১০ পৃ: ১৪৯ , বহুস ফি মেলালুন নেহাল সুবহানী খ: ৪ পৃ: ৪২ , সালফিয়ান দার গুযারে তারিখ:২৩)